বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৫ অপরাহ্ন
দেশের প্রথম আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের মূল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মুক্তাসহ ঝিনুকের আকৃতিতে ছয় তলা এই ভবনের নির্মাণ শেষ হওয়ার পর এখন অন্যান্য প্রস্তুতি চলছে। ভবনের চারিদিকে গ্লাস, ছাদের ওপর স্টিলের ক্যানোফি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, ফায়ার ফাইটিং, স্যানিটারি আর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বসালেই ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠবে সমুদ্রনগরের প্রথম এই রেলওয়ে স্টেশন। বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে চলছে এই স্টেশনের কাজ।
২০২৪ সালে সমাপ্ত হবার সিডিউল নিয়ে দ্রুত এগুচ্ছে চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প। তবে, স্বপ্নের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ সমাপ্ত হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না পর্যটন নগরবাসীকে। চলতি (২০২৩) বছরের জুন থেকে অক্টোবরে পর্যটক নিয়ে দরিয়ানগরে রেল আসার প্রত্যয়ে দ্রুত এগুচ্ছে চলমান রেল প্রকল্পের কাজ। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনা মতো কাজ এগুলে এ বছরেই রেল নিয়ে ‘শতাব্দীর স্বপ্ন’ বাস্তবে রূপ পাবে বলে আশা করছেন কক্সবাজারবাসী।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকার মতে, রেল চালু হলে পর্যটক যাতায়াত সহজ হবার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে- কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহন করা যাবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
তথ্য মতে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের উন্নয়ন অগ্রতি ও অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণে পর্যটন নগরীর সাথে রাজধানীসহ সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবী বহুদিনের। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দের উন্নিত করার পাশাপাশি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের দাবী দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নেয়।
গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে দেহাজারী-কক্সবাজার ১০০ কিমি রেল পথের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
শতাব্দীকালের রেলের সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। ২০২৩ সাল শেষ হবার আগেই কক্সবাজারে রেল আসার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে প্রকল্প ও রেল মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা। দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে রেলে চড়ে সহজে কক্সবাজারে আসবেন পর্যটকসহ সব শ্রেনী পেশার মানুষ। তেমনি সহজ ভাবে দেশের সব প্রান্তে যাবেন কক্সবাজারবাসীও। সহজ হবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আনা নেয়া। এতে বাড়বে কক্সবাজারে পর্যটক স্রোত। পর্যবেক্ষদের মতে, রেলপথ সচল হলে সবদিক দিয়ে ঘুরে যাবে কক্সবাজার অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকা।
সম্প্রতি কক্সবাজারে রেল প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন শেষে রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবরের শেষ নাগাদ দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হবে। তখন সারাদেশ থেকে মানুষ ট্রেনে চড়ে সরাসরি কক্সবাজারে যাবে।
রেলপথ মন্ত্রী কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনের নির্মাণ কাজ দেখার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে এ প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আরো বলেন, একসময় এটি স্বপ্ন ছিল, এখন সেটা বাস্তবায়নের পথে। সারাদেশের মানুষ ট্রেনে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যাওয়ার অপেক্ষায়।
রেলমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারের জন্য টুরিস্ট কোচের আদলে উন্নত মানের কোচ দিয়ে ট্রেন চালানো হবে। এজন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৪টি কোচ কেনা হবে যেগুলোর জানালা সুপ্রশস্ত। মানুষ অনায়াসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে।
এ সময় কক্সবাজার সদর-রামুর সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল, বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান, বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল বলেন, ২০১১ সালে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেল পথের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের সম্মতি না থাকায় আপাতত রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ হচ্ছে না।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদরসহ স্টেশন থাকছে আটটি। এ জন্য সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় সেতু। এ ছাড়াও রেলপথে তৈরি হয়েছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে ৫০ মিটারের একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কক্সবাজার সদর থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান আছে। নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। এর পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা যাওয়া করতে পারবেন।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানের মতে, ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের ইতোমধ্যে ৫০ কিলোমিটারের বেশি এখন দৃশ্যমান। বেশির ভাগ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে সেগুলো আগামী কয়েক মাসেই শেষ হবে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। তবে, আমরা চেষ্টা করছি ২০২৩ সালের জুন-অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করতে। একই সাথে রেলস্টেশনগুলোর নির্মাণকাজও চলমান আছে।
প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি.এম আলমগীর বলেন, এটি কক্সবাজারবাসীর মতো আমাদের কাছেও স্বপ্নের প্রকল্প। নদী-নালা-খাল বিল, পাহাড় ঘেঁষে হচ্ছে এ প্রকল্পের কাজ । ২০২৪ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও আমরা চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছি। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে কাজ করছে। নিখুঁতভাবে দ্রুত কাজ করছি আমরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে। এরপরও কাজ চলছে। একইভাবে সাগরপথে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় অন্য দেশ থেকে মালামাল আনতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশন সদস্য ও তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস লিমিটেডের চেয়ারম্যান লায়ন এম এন করিম বলেন, শতাব্দীকালের দাবি কক্সবাজার রেলপথ এখন স্বপ্ন নয়-বাস্তব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় চলতি বছরেই রেল আসার প্রতিক্ষায় রয়েছে কক্সবাজার। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল চালু হলে অবশ্যই দরিয়ানগরের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে।
কক্সবাজার সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পর্যটন ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঈনুল হাসান পলাশ বলেন, ‘সস্তায় আসা যাওয়া- সস্তায় থাকা খাওয়া’ এটি পর্যটন বিকাশের মন্ত্র। চলমান সময়ে সারা দেশ থেকে কক্সবাজার আসতে আকাশপথ ছাড়া স্থলপথে ভোগান্তি পোহাতে হয়। রেলযোগাযোগ সচল হলে যাতায়াত সহজতর হবে। তখন কম খরচে ভোগান্তিহীন কক্সবাজার পৌঁছানো গেলে পর্যটক সমাগম অবশ্যই বাড়বে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পর্যটন নগরীর সাথে রেল যোগাযোগ স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভিত্তি প্রস্তরের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডোয়েল গেজ ও সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।